প্রোজেরিয়া : একটি ভয়ংকর জেনেটিক রোগ

মাত্র ২ বছরের শিশু, অথচ চেহারা যেন ৬০ বছরের বৃদ্ধের মতো!
শুনতে অবাক লাগলেও, পৃথিবীর কিছু শিশু এমনই এক ভয়ংকর বাস্তবতার মুখোমুখি হয়।

বাংলাদেশের মাগুরায় ২০১৬ সালে শিশু বায়জিদ শিকদারের মধ্যে এমন উপসর্গ দেখা গিয়েছিল। তখন তার বয়স মাত্র চার বছর থাকলেও দেখতে একজন বৃদ্ধ মানুষের মতোই ছিল সে। ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যায় বায়জিদ শিকদার।


এই অস্বাভাবিক বার্ধক্যের পেছনে রয়েছে এক বিরল জেনেটিক রোগ প্রোজেরিয়া।
এই রোগে আক্রান্ত শিশুরা ধীরে ধীরে বৃদ্ধদের মতো চেহারা, দুর্বলতা ও স্বাস্থ্য সমস্যার শিকার হয়।

প্রোজেরিয়া কী?

প্রোজেরিয়া (Progeria), বৈজ্ঞানিকভাবে পরিচিত Hutchinson-Gilford Progeria Syndrome (HGPS) নামে, একটি অত্যন্ত বিরল জেনেটিক রোগ।
এই রোগে আক্রান্ত শিশুর শরীরে অকাল বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা দেয়, সাধারণত ১-২ বছর বয়স থেকেই।

শিশুরা জন্মের সময় দেখতে স্বাভাবিক থাকলেও, ধীরে ধীরে তাদের শরীরে এমন পরিবর্তন আসে, যা একজন বৃদ্ধ মানুষের সঙ্গেই মিলে যায়।

প্রধান লক্ষণগুলো কী কী?

• স্বাভাবিক হারে ওজন না বাড়া
• মাথার চুল ও ভ্রু পড়ে যাওয়া
• চামড়া পাতলা ও কুঁচকে যাওয়া
• অস্থিমজ্জা দুর্বল হয়ে যাওয়া
• হৃদরোগ বা স্ট্রোকের ঝুঁকি
• দাঁত উঠতে দেরি হওয়া
• ছোট ও সরু মুখ, বড় মাথা

এই রোগে আক্রান্ত শিশুদের গড় আয়ু মাত্র ১৩-১৫ বছর। তবে অনেকেই এর আগেই হৃদরোগে মারা যায়।

কেন হয় এই রোগ?

প্রোজেরিয়া হয় LMNA নামের একটি জিনের মিউটেশনের কারণে, যা কোষের কাঠামোগত ভারসাম্য নষ্ট করে।
ফলে শরীরে ‘প্রোজেরিন’ নামক একটি ক্ষতিকর প্রোটিন তৈরি হয়, যা কোষগুলোকে দ্রুত বার্ধক্যের দিকে ঠেলে দেয়।

এটি বংশগত নয়। অর্থাৎ, বাবা-মার কোনো দোষ বা গাফিলতির কারণে এই রোগ হয় না। এটি একটি দুর্ভাগ্যজনক আকস্মিক জিনগত ত্রুটি।

মায়েদের করণীয় কী?

যেহেতু এটি প্রতিরোধযোগ্য নয়, তাই কিছু সতর্কতা ও সচেতনতা খুব জরুরি:

১. গর্ভাবস্থায় নিয়মিত চেকআপ করুন:

সাধারণ পরীক্ষার পাশাপাশি, জেনেটিক ঝুঁকি থাকলে বিশেষায়িত পরীক্ষা করাতে পারেন।

২. শিশুর অস্বাভাবিক লক্ষণগুলো খেয়াল রাখুন:

ওজন কমা, মাথার চুল পড়ে যাওয়া বা অস্বাভাবিক চেহারার পরিবর্তন দেখলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

৩. জেনেটিক কাউন্সেলিং করুন:

বয়স্ক মা-বাবা, পরিবারে জেনেটিক রোগের ইতিহাস থাকলে গর্ভধারণের আগে কিংবা পরে পরামর্শ নেওয়া যেতে পারে।

৪. শিশুর মানসিক সাপোর্ট নিশ্চিত করুন:

এই শিশুরা অন্যদের মতোই স্বাভাবিক আবেগ, ভালোবাসা আর স্বপ্ন নিয়ে জন্মায়। তাই তাদের সাহচর্য ও ভালোবাসা দিন।

চিকিৎসা আছে কী?

এই রোগের কোনো স্থায়ী বা নিরাময়যোগ্য চিকিৎসা নেই। তবে কিছু চিকিৎসা পদ্ধতি ও ওষুধ উপসর্গ কমাতে সহায়তা করতে পারে:

• FTI (Farnesyltransferase Inhibitors): কোষে প্রোজেরিন জমা কমাতে সাহায্য করে।

• হার্টের যত্নে নিয়মিত ফলোআপ

• পুষ্টিকর খাদ্য ও ফিজিওথেরাপি

• মানসিক সাপোর্ট থেরাপি

গবেষণায় কিছু অগ্রগতি হলেও, এখনো পর্যন্ত এটি একটি লাইফ-লিমিটিং কন্ডিশন।

প্রোজেরিয়া রোগীদের জীবন কেমন হয়?

এই শিশুরা স্কুলে যায়, আঁকতে ভালোবাসে, গল্প বলতে চায়, আর দশটা শিশুর মতোই স্বপ্ন দেখে।
কিন্তু তাদের প্রতিদিনের জীবন জর্জরিত থাকে হাড়ের ব্যথা, ক্লান্তি, হৃদযন্ত্রের দুর্বলতা ও শারীরিক সীমাবদ্ধতায়।
তারপরও তারা হাসে, ভালোবাসে, বাঁচতে চায় এটাই তাদের সবচেয়ে বড় শক্তি।

শেষ কথা:


প্রোজোরিয়ায় আক্রান্ত শিশুরা খুব অল্প বয়সেই জীবন হারায়। তাই শিশুর শরীরে এমন কোন লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন। খুব অল্প বয়সেই জীবন হারায়। তাই শিশুর শরীরে এমন কোন লক্ষণ দেখা দিলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

আর যারা আক্রান্ত হয়েছে, তারা যেন ভালোবাসা ও সাহচর্য পায় সেটা নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব।

চলো, আমরা সবাই মিলে এই শিশুদের পাশে দাঁড়াই।
তাদের হাসির কারণ হই, তাদের গল্প ছড়িয়ে দিই, যেন এই পৃথিবীটা তাদের জন্য একটু হলেও সুন্দর হয়ে ওঠে।

সচেতন হোন, সহানুভূতিশীল হোন — কারণ আপনাদের সুস্থতাই আমাদের কাম্য।
ধন্যবাদ।