লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস রোগের ব্যাপারে যা জানা জরুরি

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস রোগের ব্যাপারে যা জানা জরুরি, এই রোগটিকে বাংলায় অনেকে ‘হাতি পা রোগ’ নামে চেনেন।
সঠিক সময়ের চিকিৎসা, সচেতনতাই পারবে এই রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আপনাকে বাঁচাতে।

ছেলেটির পা অস্বাভাবিকভাবে ফুলে গেছে দেখেই মনে হচ্ছে প্রতিটি দিন যেন তার জন্য একেকটা ভারী বোঝা।
চলাফেরা, বসা বা দাঁড়ানো সবকিছুতেই লেগে আছে সীমাহীন কষ্টের ছাপ।

ছবিটি দেখে অনেকেই মনে মনে নিজেকে প্রশ্ন করছেন, কী রোগে এমন হয়? এটা কি ছোঁয়াচে? আর কখনো কি সেরে ওঠা সম্ভব?
আসলে এটি কোনো অভিশাপ নয়, নয় কোনো অলৌকিক ঘটনা। এটি একটি চিকিৎসাযোগ্য পরজীবী ঘটিত রোগ

যার নাম লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস, এই রোগটিকে বাংলায় অনেকে ‘হাতি পা রোগ’ নামে চেনেন।
সঠিক সময়ের চিকিৎসা, সচেতনতাই পারবে এই রোগে আক্রান্ত হওয়া থেকে আপনাকে বাঁচাতে। তাই চলুন

জেনে নেই লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস রোগটির সর্ম্পকে।

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস কী?

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস একটি দীর্ঘমেয়াদি পরজীবীজনিত সংক্রমণ, যা ফাইলেরিয়া নামক কৃমির কারণে হয়ে থাকে।

এই কৃমি মশার মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে দেহের তরল প্রবাহের গুরুত্বপূর্ণ অংশ লিম্ফ্যাটিক

সিস্টেমে আঘাত হানে। এর ফলে মানুষের শরীরের নির্দিষ্ট কিছু অংশ বিশেষ করে পা, হাত, অণ্ডকোষ বা স্তন অস্বাভাবিকভাবে

ফুলে যায়। এই অবস্থাকেই বলা হয় এলিফান্টিয়াসিস, যা শুধু শারীরিক যন্ত্রণা নয়, মানুষের আত্মবিশ্বাস ও মানসিক অবস্থাকেও

গভীরভাবে আঘাত করে। আক্রান্ত ব্যাক্তিদের বহন করতে হয় যন্ত্রণা, লজ্জা আর সমাজের বিরূপ দৃষ্টিও। তবে মনে রাখা জরুরি

এটি কোনো অভিশাপ বা অলৌকিক ঘটনা নয়। এর সঠিক চিকিৎসা রয়েছে। সচেতনতা, সঠিক পরিচর্যা আর সহানুভূতির হাত

ধরলেই একজন আক্রান্ত মানুষ ফিরে পেতে পারে একটি স্বাভাবিক জীবন।

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস কেন হয়?

এই রোগের পেছনে রয়েছে কিছু নির্দিষ্ট, কিন্তু প্রতিরোধযোগ্য কারণ,

• পরজীবী কৃমির সংক্রমণ:
ফাইলেরিয়া নামক পরজীবী মশার মাধ্যমে মানুষের দেহে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে ক্ষতি করে লিম্ফ্যাটিক সিস্টেমকে।

• বারবার মশার কামড়:
যেসব এলাকায় মশার উপদ্রব বেশি, সেখানে বারবার কামড়ের ফলে কৃমির সংক্রমণ বাড়তে থাকে এবং রোগটি ধীরে ধীরে ভয়াবহ রূপ নেয়।

• পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার অভাব:
জমে থাকা পানি ও অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ মশার প্রজননের জন্য আদর্শ। ফলে বাড়ে সংক্রমণের আশঙ্কা।

• ঔষধ না খাওয়া:
প্রতি বছর সরকার যেসব প্রতিরোধমূলক ঔষধ বিনামূল্যে বিতরণ করে, তা অনেকেই খেতে অনীহা প্রকাশ করেন বা অবহেলা করেন, ফলে থেকে যায় সংক্রমণের ঝুঁকি।

• সচেতনতার অভাব:
অনেকেই এই রোগ সম্পর্কে জানেন না, আর জানলেও ভয়, লজ্জা বা সামাজিক অপমানের আশঙ্কায় চিকিৎসা নিতে দ্বিধাবোধ করেন।

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিসের লক্ষণসমূহ:

এই রোগ ধীরে ধীরে শরীরে ছড়িয়ে পড়ে এবং আক্রান্ত ব্যক্তির জীবনে নিয়ে আসে নানা শারীরিক ও মানসিক কষ্ট। এর সাধারণ লক্ষণগুলো হলো,

• পা, হাত, অণ্ডকোষ বা স্তন অস্বাভাবিকভাবে ফুলে যাওয়া – ধীরে ধীরে অঙ্গগুলো ভারী ও বিকৃত হয়ে পড়ে।


• ব্যথা, জ্বালা বা তীব্র অস্বস্তি – আক্রান্ত অংশে প্রায়ই থাকে অসহনীয় অস্বস্তি ও যন্ত্রণা।


• ত্বক মোটা ও শক্ত হয়ে যাওয়া – ত্বক ক্রমশ মোটা, শক্ত ও খসখসে হয়ে যায়, দেখতে অস্বাভাবিক লাগে।


• জ্বর বা ঘন ঘন সংক্রমণ – সংক্রমণের কারণে জ্বর ও আক্রান্ত অঙ্গে পুঁজ বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে।


• দৈনন্দিন কাজকর্মে বাধা – চলাফেরা, কাজ করা এমনকি বিশ্রাম নিতেও অসুবিধা হয়।

• আত্মসম্মানে আঘাত ও মানসিক ভেঙে পড়া – রোগীর মনে গড়ে ওঠে লজ্জা, অবহেলা আর একাকিত্বের বেদনা।

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ:

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিসের চিকিৎসা ও প্রতিরোধ
এই রোগটি যতটা ভয়াবহ মনে হয়, ততটাই প্রতিরোধযোগ্য শুধু প্রয়োজন সময়মতো সঠিক পদক্ষেপ আর কিছু সহজ অভ্যাস গড়ে তোলা।

১. নিয়মিত ঔষধ গ্রহণ:
প্রতি বছর সরকার বিনামূল্যে যে ফাইলেরিয়া প্রতিরোধী ঔষধ সরবরাহ করে, তা খাওয়াই এই রোগ প্রতিরোধের সবচেয়ে কার্যকর উপায়।

২. ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা:
দেহের আক্রান্ত অংশ পরিষ্কার ও শুকনো রাখা, প্রতিদিন সাবান দিয়ে পা ধোয়া, পরিষ্কার কাপড় ব্যবহার করা রোগ নিয়ন্ত্রণে বড় ভূমিকা রাখে।

৩. মশার নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা:
মশারি ব্যবহার, জমে থাকা পানি পরিষ্কার করা এবং বাসা-আশেপাশে মশা নিধনের ব্যবস্থা নেওয়া সংক্রমণের ঝুঁকি কমায়।

৪. চিকিৎসা ও থেরাপি গ্রহণ:
ব্যথা ও ফোলা কমাতে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী থেরাপি, ব্যায়াম বা প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করলে রোগ নিয়ন্ত্রণে থাকে এবং স্বাভাবিক চলাফেরা সহজ হয়।

৫. মানসিক সহায়তা ও সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা:
রোগীকে ছোট না করে তার পাশে দাঁড়ান। সাহস, ভালোবাসা ও সম্মান একজন মানুষের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে পারে।

আমাদের করণীয়:

এই রোগ প্রতিরোধে সমাজের প্রতিটি মানুষের কিছু করণীয় আছে,
• প্রতি বছর সরকার প্রদত্ত ঔষধ গ্রহণ ও অন্যদের উৎসাহ দেওয়া
• পরিবার ও প্রতিবেশীদের সচেতন করা
• কুসংস্কার ও ভ্রান্ত ধারণা দূর করা
• আক্রান্তদের সম্মান ও সহানুভূতির সাথে দেখা
• মশার জন্মস্থল ধ্বংস করা
• চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করা

উপসংহার:

লিম্ফ্যাটিক ফাইলেরিয়াসিস কোনো অভিশাপ নয়। এটি একটি প্রতিরোধযোগ্য রোগ, যার সমাধান রয়েছে আমাদের হাতেই।
আপনার একটি সচেতন সিদ্ধান্ত, একটি সঠিক পদক্ষেপ কাউকে এই দুর্ভোগ থেকে মুক্তি দিতে পারে।
আসুন, সহানুভূতি ও সচেতনতার হাত বাড়িয়ে দিই।
কুসংস্কার ভেঙে, গড়ি সুস্থ সমাজ।
আপনার সুস্থতাই আমাদের কাম্য, ধন্যবাদ।